লিডিং ইউনিভার্সিটিতে সৈয়দ মুজতবা আলীকে নিয়ে মূল্যায়ন অনুষ্ঠান ‘সৈয়দ মুজতবা আলী: স্মরি বিস্ময়ে’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০) সন্ধ্যা ৭টায় শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর স্মরণে অনলাইনে, অালোচনা, পর্যালোচনা, পাঠ এবং তাঁর পছন্দের রাগ/রাগাশ্রয়ী সংগীত পরিবেশিত হয়। লিডিং ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শ্রীযুক্ত বনমালী ভৌমিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে লিডিং ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান দানবীর ড. সৈয়দ রাগীব আলী এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে লিডিং ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য সৈয়দ আব্দুল হাই উপস্থিত ছিলেন। এতে আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে উচ্চাঙ্গ সংগীত, খেয়াল এবং মধ্যযুগের একটি বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন উস্তাদ মঙ্গল চন্দ্র মণ্ডল।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. রাগীব আলী বলেন, মানবজীবনের অভিজ্ঞতা সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবলভাবে ছিল। তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যটনের মাধ্যমে মানবচরিত্রের বৈচিত্র্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে তা সাবলীল হাস্যরসের জারকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে উপস্থাপন করেছেন। গল্প বলার অনিবার্য কৌশল মুজতবা আয়ত্ত করেছিলেন বলেই তিনি এমন সুরসিক হতে পেরেছেন। তিনি বলেন, মধুময়কে আরও মধুরতর করে তোলাই শিল্পীর কাজ বলেই মুজতবার শিল্পরসবোধ উচ্চকিত হয়েছে। তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর কর্মজীবনকে স্মরন করে আজকের এ অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য উপাচার্য বনমালী ভৌমিকসহ সকলকে ধন্যবাদ জানান।
উপাচার্য বনমালী ভৌমিক বলেন, সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাস্যরস নির্মাতা ও হাস্যরসের গল্পকার। তিনি কখনো গল্পে, কখনো প্রবন্ধে, চিঠিতে, অথবা কখনো গল্প-প্রবন্ধের মিশ্রিত আঙ্গিকে ও স্মৃতিচারণের কৌশলে চমৎকার শৈল্পিক ও বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস পরিবেশন করেছেন। জীবনের গভীরতার ভেতর থেকে জীবনকে পর্যবেক্ষণের অন্তর্দৃষ্টি মুজতবার ছিল বলেই তাঁর পরিবেশিত হাস্যরসের মধ্যে পরিমিত জীবনময়তা ছিল। তিনি আরও বলেন, জীবনের বেদনাক্লিষ্ট এবং করুণতম অভিজ্ঞতাকে সংবেদনশীলতার প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে দেখতে পেরেছেন বলেই বাংলা হাস্যরস সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর অবস্থান শাশ্বত। তিনি এ অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য আয়োজক কমিটিকে এবং যারা এতে অংশগ্রহণ করে অনুষ্ঠানকে মহিমান্বিত করেছেন তাদের প্রতি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানে মূখ্য আলোচক হিসেবে সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করেন লিডিং ইউনিভার্সিটি কলা ও আধুনিক ভাষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৯০৪ সালে, তিনি সিলেটের গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন এবং তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথমদিকের ছাত্র। সেখানে তিনি বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ফরমিকির অধীনে সংস্কৃত ভাষা, সাংখ্য ও বেদান্ত অধ্যয়ন করেন, ড. মার্ক কলিন্স ও মরিসের নিকট ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান, বগদানফের নিকট ফারসি ও আরবি এবং তুচ্চির নিকট ইতালিয়ান শেখেন। এখান থেকে বি.এ. ডিগ্রী নিয়ে এরপর তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য ‘হুমবল্ট’ বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি মিশরের কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কর্মজীবনে সৈয়দ মুজতবা আলী কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজ, বরোদা কলেজ, বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তাছাড়া তিনি দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রাণালয়, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টর এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্সের সচিব ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকে নরসিং দাস পুরস্কার এবং আনন্দ পুরস্কার প্রদান করা হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। গ্রন্থাকারে তাঁর মোট ত্রিশটি উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্যে ভ্রমণকাহিনী দেশে-বিদেশে, জলে-ডাঙায়, উপন্যাস অবিশ্বাস্য, শবনম, শহর-ইয়ার, রম্যরচনা পঞ্চতন্ত্র, ময়ূরকন্ঠী এবং ছোটগল্প চাচা-কাহিনী এবং টুনি মেম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি অনবদ্য গ্রন্থ পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তিনি দেশে-বিদেশে গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যঙ্গনে প্রথম প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাঠকচিত্ত জয় করতে সক্ষম হন।
স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা জেরিনা হোসেন ১৯৭১ সালে সৈয়দ মুজতবা অালীর সঙ্গে দেখা হওয়ার মনোজ্ঞ স্মৃতিচারণ করেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনাবক্তব্যে অনুষ্ঠান আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ও লিডিং ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মোস্তাক আহমাদ দীন বলেন, সৈয়দ মুজতবা আলী একজন সব্যসাচী ও বহুমাত্রিক লেখক। তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল অপরিসীম। ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথের সিলেট অাগমনের সূত্র ধরে রবীন্দ্র-সংস্পর্শে যান এবং পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যান। তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ এবং অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের অধিকারী।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে লিডিং ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার মেজর (অব) মো. শাহ অালম, পিএসসি অনুষ্ঠানের উপস্থিত সবাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সৈয়দ মুজতবা অালীর রসবোধ ও পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করেন।
লিডিং ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. কাওসার হাওলাদার ও ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মানফাত জাবিন হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন আধুনিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম. রকিব উদ্দিন, প্রক্টর মো. রাশেদুল ইসলাম এবং আয়োজক কমিটির সদ্যস্য সচিব ও ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। এতে স্বরচিত ছড়া পাঠ করেন স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান স্থপতি রাজন দাশ। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রবি-পুরাণ’ স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুম্পা শারমিন। পঞ্চতন্ত্রের একটি প্রবন্ধ ‘ইউরোপে ভারতীয় ভারতীয় শাস্ত্র প্রবন্ধ পাঠ করেন ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক তৌহিদা সুলতানা এবং একটি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন আবু সাইদ মো. নাহিদ।
বুদ্ধি আর রসবোধের গল্পের পর সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রেমের আকুতি, অনুভূতি, গভীরতা আর প্রেম পেয়ে হারানোর বেদনার যে ধ্রুপদি বর্ণনা তাঁর ‘শবনম’ উপন্যাসে তা রবীন্দ্র নাথের ‘হেনা’ গল্পের সাথে তুলনামূলক আলোচনা করেন ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এনাম আহমেদ। তখন যেন সকল শ্রোতা হারিয়ে গিয়েছিল এক ভিন্ন জগতে। সৈয়দ মুজতবা আলী মানেই গভীর অনুভূতি, পাণ্ডিত্য, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা আর এরই সঙ্গে স্বভাবসিদ্ধ তীব্র রসিকতার যে সংমিশ্রণ তা আমাদেরকে ক্ষণিকের জন্য হলেও নিয়ে যায় অন্য কোনো আনন্দের রাজ্যে। মানুষ হিসেবে বাস্তবে যদিও আমরা আছি ভিন্ন কোনো পরিবেশে, জীবনযন্ত্রণার ভেতরে, তবুও জীবনের এই সব যন্ত্রণা থেকে সৈয়দ মুজতবা আলী আমাদেরকে ক্ষণে ক্ষণে উপশম দেন।